ব্লকচেইন কি? সেন্ট্রালাইজেশন ও ডিসেন্ট্রালাইজেশন এর তুলনা। ক্রিপ্টোগ্রাফি কি?

Jakia Binte Amin
5 min readJan 9, 2022

--

🔰 ওয়েব ৩.০ নিয়ে কথা বলতে গেলেই কিছু শব্দ সামনে চলে আসে যার মধ্যে কয়েকটি হলো “ব্লকচেইন”, “সেন্ট্রালাইজেশন” ও “ডিসেন্ট্রালাইজেশন”। ওয়েব ৩.০ এর আরও বিষদ আলোচনায় যেতে হলে আমাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে ধারনা রাখা জরুরি। আজকে টপিকগুলো নিয়ে কিছু সরল-সহজ আলোচনার মাধ্যমে এগুলো সম্পর্কে ধারণা অর্জনের চেষ্টা করা যাক।

১. ব্লকচেইনঃ ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে ব্লকচেইন নিয়ে কাজ করা হলে ও তা সফলতার মুখ দেখে নি। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে সাতোশি নাকামতো নামের এক ব্যাক্তি বিটকয়েন নামক ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্লকচেইন কে কাজে লাগান।

ব্লকচেইন নামের মধ্যেই এর ভাববস্তু লুকায়িত আছে। ব্লক+চেইন অর্থাৎ ব্লকের তৈরি শিকল যেখানে যেকোনো কিছুর মালিকানা সরাসরি হস্তান্তর করা যায়। ব্লকচেইন একধরনের ডিস্ট্রিবিউটেড ডেটাবেস যাতে সব ধরনের লেনদেন/ডেটা চেইন আকারে সংরক্ষিত থাকে। আপনি এগুলো ব্লক হিসাবে দেখতে পারেন যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেনদেন (ডেটা) সংরক্ষন করে। এই ব্লকগুলি ক্রিপ্টোগ্রাফির সাথে একসাথে যুক্ত। (ক্রিপ্টোগ্রফি কি তা জানতে পারবেন পোস্টের নিচের অংশে)

কঠিন না করে ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে চলুন বুঝে আসি।

কয়েকদিন আগের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি। ইদানিং ফেসবুকে অনেক বেশি পরিমানে এড আসে। এতে দেশের অনেক নামকরা মেন্টরদের কোর্স গুলো কম টাকায় বিক্রি করার এক চক্র বের হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটেই বলি।

➡️ ধরুন, আপনি কোনো একটি কোর্সের মালিক। আপনি এই কোর্সের পাশে যতই কপিরাইট লিখে রাখেন কিংবা কপি করার জন্য যাই শাস্তি নির্ধারণ করেন এই মনুষ্যজাতি কোনো না কোনো উপায় বের করে ঠিকই সেই কোর্স ডাউনলোড করে নিবে । তার চেয়েও জঘন্য হলো কিছু দুষ্টচক্র আছে যারা সেগুলো কিছুটা কম দাম দিয়ে বিক্রি করে দিবে (খুবই নিন্দনীয় কাজ, অন্যের হক মেরে খাওয়া উচিত না) । সে এটা করে যা পেলঃ প্রথমত সে কোনো কষ্ট করলো না। আপনার কন্টেন্ট বিক্রি করে সে যাই ইনকাম করুক তার লাভ। দ্বিতীয়ত আপনি সেই সব অডিয়েন্সদের থেকে যেই মূল্য টা পেতেন তা হারালেন এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।

➡️ কিন্ত ব্লকচেইন আপনার জন্যে যেই সমাধান নিয়ে আসতে চলেছে তা হলোঃ ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে আপনি নিজেই নির্ধারণ করতে পারবেন আপনার কন্টেন্ট এর এক্সেস আপনি কাকে দিবেন। এবং ভবিষ্যতে যদি সেই ব্যক্তি আপনার কন্টেন্ট অন্য কারো কাছে বিক্রি করে তাহলে সেখান থেকে আপনি কিছু অংশ কমিশন পাবেন। এই প্রক্রিয়া টি যত দীর্ঘায়িত হবে আপনি আপনার একটি অংশ সেখান থেকে পেতে থাকবেন। এবং এই পুরো প্রক্রিয়াটি চেইন আকারে ডেটাবেসে সংরক্ষিত হবে। যার ফলে আপনি দেখতে পারবেন কে কার কাছে কন্টেন্ট এর মালিকানা বিক্রি করলো। অর্থাৎ প্রতিটি কাজের রেকর্ড থাকবে।

এছাড়া বিষয়টি আপনার কোনো কপিরাইটেড ইমেজ, আর্টিকেল বা আপনার মালিকানাধীন যেকোনো বিষয়ের সাথেই হতে পারে। মাঝেমধ্যে এমন হয় যে আপনার কপিরাইট করা কোনো ছবি কোনো এক মেঘ বালিকা কিংবা প্রিন্স বালক প্রোফাইল পিকচার দিয়ে দিলো 😛( হয়ত না বুঝেই)। অনেকে আবার মিসইউজের লক্ষ্যে সেগুলো ব্যবহার করে। কিন্ত ব্লকচেইনের কারণে মালিকানা ক্রয় করা ছাড়া এভাবে ব্যবহার করা প্রায়ই অসম্ভব এবং যদি মিসইউজ হয় তাহলে সেটি ডেটাবেসে রেকর্ড থেকে যাবে যার ফলে আপনি নিজেই খুব সহজে মিসইউজ করা ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পারবেন।

ইনকাম, প্রাইভেসি, সিকিউরিটি এর মতন ক্ষেত্রগুলো বিবেচনা করলে এটি খুব বড় ধরনের একটি বিবর্তন হতে চলেছে।

➡️ এত এত সুবিধার কথা বললাম অসুবিধা গুলো তুলে না ধরলেই নয়। ওয়েব ৩.০ এর আগে পর্যন্ত যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ছিলো “সেন্ট্রাইলাইজড”। ওয়েব ৩.০ যেই বিবর্তন নিয়ে আসতে চলেছে তাতে সর্বোচ্চ ফোকাস করা হয়েছে যে বিষয়ের ওপর তা হলো “ডিসেন্ট্রালাইজেশন”। চলুন এইবার একটু তুলনা করে বুঝার চেষ্টা করি এই প্রযুক্তিগুলোর বিবর্তনে আমরা কি পাচ্ছি আর কি হারাচ্ছিঃ

২। সেন্ট্রালাইজেশনঃ যখন থার্ড পার্টি বা মিডলম্যানের হাতে বেশির ভাগ কন্ট্রোল থাকে সেটাকে আমরা বলি সেন্ট্রালাইজেশন। এই প্রক্রিয়ায় কোনো একটি সাইট কিংবা অ্যাপ ব্যবহার করার জন্য আপনি সেই কম্পানিকে নিজের বিভিন্ন ডেটা গুলোর এক্সেস দিতে হয়। যেমনঃ লোকেশন, মিডিয়া ইত্যাদি। তাদের যেই পলিসি গুলো থাকে সেগুলো তে “allow” না দিয়ে আপনি সামনে অগ্রসর হতেই পারেন না।

অনেক সময় খেয়াল করবেন আপনি আপনার কোনো ফ্রেন্ড কে বললেন আপনি একটি ঘড়ি কিনতে চাইছেন এবং তারপর ফেসবুকে গেলেন আপনার সামনে শুধু ঘড়ির বিজ্ঞাপন আসতে থাকলো। কিন্ত এটা হলো কিভাবে?

মূলত আপনি ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টিকটক কিংবা আপনার ব্যবহৃত অন্য অ্যাপ গুলোতে অনেকগুলো এক্সেস দিয়ে থাকেন। আপনার প্রতিটি ইনফরমেশন তাদের কাছে ডেটা। এই ডেটা গুলো তারা বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে এড কোম্পানি গুলোর কাছে। যার ফলে আপনার ডেটার ওপর ভিত্তি করেই তাঁরা আপনার জন্য পার্সোনালাইড বিজ্ঞাপন গুলো দেখায়।

এই প্রক্রিয়ায় আপনার ডেটা গুলো সেই কোম্পানির কেন্দ্রীয় সার্ভারে জমা থাকে। এবং আপনাকে সেই অ্যাপ ব্যবহারের বিনিময়ে এই ডেটা গুলো দিতেই হয়।

একটা সাইট কিংবা অ্যাপের বাইরে এই প্রক্রিয়ার উদাহরন হতে পারেঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা সরকার। সেন্ট্রালাইজেশনের ক্ষেত্রে বেশকিছু স্তর বা ধাপ রয়েছে যেখানে কর্তৃপক্ষই শীর্ষে থাকে।

➡️ সুবিধাঃ এই প্রক্রিয়ায় সব ডেটা এক জায়গায় সংরক্ষিত থাকায় সমস্ত প্রোগ্রাম একবারেই এক্সিকিউট হয় যার ফলে কার্যক্ষমতা ভালো থাকে। আপডেট করা অনেক বেশি সহজ হয়। যেমনঃ ফেসবুক বা ইউটিউব আপডেট করার জন্য তাদের প্রতিটি ব্যবহারকারীর অনুমতির প্রয়োজন নেই।

➡️ অসুবিধাঃ থার্ড পার্টি তথা কোম্পানিগুলো যেভাবে চাই সেভাবেই করে এবং ইচ্ছামতো আপনার ডেটা ব্যবহার করতে পারে। সব কিছু এক জায়গায় স্টোর থাকায় হ্যাকিং কিংবা সাইবার অ্যাটাক এর ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা একক প্রতিষ্ঠান কে টার্গেট করলেই সবকিছুর এক্সেস পাওয়া যায়।

৩। ডিসেন্ট্রালাইজেশনঃ যখন কোনো একক প্রতিষ্ঠান সার্বোভৌম ক্ষমতার মালিক নয় এই প্রক্রিয়াটিই হলো ডিসেন্ট্রালাইজেশন। (উপরের ব্লকচেইন নিয়ে পড়লে বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে যাবে) ; ডিস্টিবিউটেড নেটওয়ার্কের ফলে প্রত্যেকেই নিজের ডেটার মালিক। এবং সেগুলোর ব্যবহার কিংবা যেকোন সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে(অনেকটা স্বাধীনতার মতো)।

➡️ সুবিধাঃ আপনার ডেটার ওপর আপনার পুরোপুরি কন্ট্রোল থাকে এবং সেটির ব্যবহার আপনিই নির্ধারণ করতে পারেন। তাছাড়া এককভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা না থাকায় পুরো ডিসেন্ট্রালাইড একটি সিস্টেমকে আক্রমন করা কঠিন; কারণ এটি করার জন্য পুরো নেটওয়ার্ক কিংবা কমপক্ষে ৫১ শতাংশ নামিয়ে নিতে হবে, যেটা সেন্ট্রালাইড সিস্টেমের সম্পূর্ণ বিপরীত।

➡️ অসুবিধাঃ প্রতিটি কম্পিউটারে ডেটার একটি কপি বা অনুলিপি থাকায় প্রোগ্রামগুলি নেটওয়ার্ক জুড়ে রি-এক্সিকিউট (পুনরায় কার্যকর) করা হয়। এর ফলে আপনি যখন কিছু আপডেট করতে চান, এটি সেই নেটওয়ার্কের প্রতিটি কম্পিউটারে আপডেট করতে হবে। যা এই প্রক্তিয়াটিকে ধীরগতিসম্পন্ন করে তোলে এবং কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

সংক্ষিপ্ত করে বলতে গেলে, সেন্ট্রালাইজড সিস্টেমে কার্যক্ষমতার জন্য আপনি নিজের প্রাইভেসি তথা গোপনীয়তা এবং স্বাধীনতা সেক্রিফাইজ করেন।

অপরপক্ষে, ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেম কিছুটা ধীরগতির হলেও আপনার কাছেই একটি ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্ক থাকে এবং আপনার প্রাইভেসি ও স্বাধীনতা থাকে।

➡️ ক্রিপ্টোগ্রাফিঃ ক্রিপ্ট অর্থ হলো “লুকানো” এবং গ্রাফি অর্থ হলো “লিখা”। এলোমেলো অক্ষর এবং সংখ্যার একটি সিরিজ (গোপন লেখা) যা মূলত অন্যদের থেকে তথ্য গোপন করে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে ক্রিপ্টোগ্রাফি। এটি লেনদেন এবং পরিচয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই প্রক্রিয়াটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক কী জেনারেশন, ডেটার প্রাইভেসি রক্ষার জন্য যাচাইকরণ (ভেরিফিকেশন), ইন্টারনেটে ওয়েব ব্রাউজিং এবং ক্রেডিট কার্ড লেনদেন ও ইমেলের মতো গোপনীয় যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়। (পরবর্তী পার্ট গুলোতে আরও বিষদ আলোচনা করা হবে)

ওয়েব ৩.০ আরও অনেক ইন্টারেস্টিং কথা হবে এবং এই সিরিজ চলবে………

--

--